বাংলাদেশের চাকরি বাজার: নতুন সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের চাকরি বাজার: নতুন সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের চাকরি বাজারের বর্তমান অবস্থা, নতুন উদ্ভূত সুযোগ এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে বর্তমান পরিস্থিতি কী। চাকরি খোঁজার প্রক্রিয়ায় প্রতি বছর হাজার হাজার তরুণ-তরুণী যোগ দেন, কিন্তু সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি হয় না। যদিও বিভিন্ন খাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তবুও বেকারত্বের সমস্যা এবং চাকরির মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এই প্রতিবেদনটি বর্তমান চাকরি বাজারের চিত্র তুলে ধরবে এবং আগামী দিনের জন্য কর্মসংস্থান নিয়ে কীভাবে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত, তা নিয়ে আলোচনা করবে।

১. চাকরি বাজারের বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশের চাকরি বাজার গত কিছু বছর ধরে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। দেশের তরুণ জনগণের বিশাল অংশ চাকরি খোঁজার জন্য বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আবেদন করছে, কিন্তু সেখানে প্রতিযোগিতা বেশ তীব্র। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রকল্প, নতুন আইটি প্রকল্প এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মসূচি চাকরি বাজারে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। তবে, যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, বেকারত্বের হার এখনও অনেক বেশি। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চাকরির সুযোগ রয়েছে পোশাক শিল্প, কৃষি, নির্মাণ, সেবা খাত, এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে। তবে, কিছু খাতে কাজের শর্ত এবং কর্মপরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পোশাক শিল্পে কাজের পরিস্থিতি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অনেক সরকারি দপ্তরের চাকরি নিয়ে নানা সমস্যা। তবুও, এ ধরনের কর্মসংস্থান তরুণদের মধ্যে প্রচুর জনপ্রিয়।

২. নতুন সুযোগ এবং উদ্যোগ

বিগত কিছু বছর ধরে বাংলাদেশের চাকরি বাজারে সাড়া জাগানো অনেক নতুন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। উদাহরণস্বরূপ, ‘উদ্যোক্তা ব্যাংক’ বা ‘স্টার্টআপ ফান্ড’ সহ বিভিন্ন প্রকল্প তরুণদের জন্য ব্যবসা শুরু করতে সহায়তা করছে। এছাড়া, তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) এবং সফটওয়্যার শিল্পের প্রতি সরকারের নজর বৃদ্ধি পেয়েছে। আজকাল, আইটি খাতে বিশেষভাবে একাধিক নতুন স্টার্টআপ এবং বিদেশি কোম্পানির শাখা গঠিত হচ্ছে, যার ফলে তথ্য প্রযুক্তি পেশায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

বিশেষভাবে, রিমোট ওয়ার্কিং (দূরবর্তী কাজ) এর প্রবণতা বাংলাদেশে বেড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর পর অনেক কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের রিমোট কাজ করার সুযোগ দিয়েছে, যা চাকরি খোঁজার জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছে। আইটি, গ্রাফিক ডিজাইন, কনটেন্ট রাইটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, ট্রান্সলেশন, এবং অন্যান্য সৃজনশীল কাজগুলো এখন ঘর থেকেই করা সম্ভব, যা চাকরি বাজারে এক ধরনের বিপ্লব সৃষ্টি করেছে।

৩. যুবকরা কেন বেকার রয়েছেন?

বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনগণের মধ্যে যারা চাকরি খুঁজছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে চাকরি পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিলেবাসের মধ্যে কিছু তাত্ত্বিক পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করেছে, কিন্তু আধুনিক শিল্পপ্রযুক্তির সাথে সমন্বিত দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, এক্সেল, প্রোগ্রামিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক ডিজাইন এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা যেগুলোর মাধ্যমে চাকরির বাজারে প্রবেশ করা সম্ভব, সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের তেমন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে না।

তাছাড়া, নেটওয়ার্কিংয়ের অভাবও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। দেশে অনেক তরুণ শিক্ষার্থী বা চাকরিপ্রার্থী একে অপরের সাথে যোগাযোগের সুযোগ না পাওয়ায় কর্মসংস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা পায় না। এ কারণে তারা সুযোগের সম্ভাবনা সম্পর্কে অবহিত থাকেন না।

৪. সরকারি চাকরি: জনপ্রিয়তা এবং বাস্তবতা

বাংলাদেশে সরকারি চাকরি এখনও সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষত, সরকারি চাকরির নিরাপত্তা, সুবিধা, এবং সমাজের একটি সম্মানজনক স্থান পাওয়ার কারণে দেশের অধিকাংশ তরুণ সরকারি চাকরি পেতে আগ্রহী। কিন্তু, সরকারি চাকরির জন্য কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক এবং আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পথ এত সহজ নয়।

সরকারি চাকরির পরীক্ষায় আবেদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের যোগ্যতা এবং কাঠামো রয়েছে। যেমন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ বাহিনী, এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোর পদে চাকরি পাওয়ার জন্য নিবন্ধন, পরীক্ষা, সাক্ষাৎকারসহ কঠোর প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এছাড়াও, অনেক ক্ষেত্রেই চাকরির প্রতি দীর্ঘমেয়াদি আগ্রহ এবং প্রস্তুতির অভাবও তরুণদের দুর্বলতার একটি বড় কারণ।

৫. আন্তর্জাতিক বাজারে কর্মসংস্থানের সুযোগ

বাংলাদেশের কর্মী সম্প্রদায়ের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারেও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীরা দক্ষতার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে, বিশেষ করে নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা, এবং আইটি সেক্টরে। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব এবং অন্যান্য দেশের সরকার বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নেওয়ার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশ সরকারের ‘মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর পরিকল্পনা’, ‘ভারতীয় সফটওয়্যার ও আইটি শিল্পে বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ’ ইত্যাদি উদ্যোগ আমাদের কর্মী সম্প্রদায়ের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে, এসব কর্মসংস্থানের সুযোগের জন্য দক্ষতা এবং ভাষাগত যোগ্যতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই যারা আন্তর্জাতিক বাজারে কাজ করতে চান, তাদের জন্য বিদেশি ভাষার শিক্ষা, সাংস্কৃতিক জ্ঞান, এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৬. চাকরির বাজারের ভবিষ্যৎ: কীভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যাবে?

বাংলাদেশের চাকরি বাজারে আগামী কিছু বছরে অনেক পরিবর্তন আসবে, বিশেষ করে প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি অনুযায়ী। এজন্য তরুণদের উচিত নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া, প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করা এবং আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে মনোযোগ দেওয়া। এর মাধ্যমে তারা একদিকে যেমন স্থানীয় বাজারে, তেমনি আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারে ভালো সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের চাকরি বাজারে বর্তমানে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকার পরও, একই সঙ্গে নতুন সুযোগের ক্ষেত্রও রয়েছে। তবে, চাকরি খোঁজার পদ্ধতি পরিবর্তন ও দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি দেশের যুবকদের জন্য সরকারের নানা উদ্যোগ এবং বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে চাকরির সুযোগের সৃজন হচ্ছে। তরুণদের জন্য ভবিষ্যত উজ্জ্বল, তবে সঠিক প্রস্তুতি এবং উপযুক্ত দক্ষতার মাধ্যমে তারা অবশ্যই চাকরি বাজারে নিজেদের স্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *